যখন ডিজিটাল জগতের আবহে সন্তানদের বড় করার বিষয়টি আসে, তখন মা-বাবারা সাধারণত সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি করেন তা হলো, "___ বছরের বাচ্চার স্ক্রিন টাইম কতক্ষণ হওয়া উচিত অর্থাৎ মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস কতক্ষণ ব্যবহার করা উচিত?" প্রযুক্তি ব্যবহার করেন এমন বাচ্চাদের জন্য যে স্বাস্থ্যকর সীমা থাকা উচিত, তা বোঝার জন্যই সাধারণত এই প্রশ্ন করা হয়। জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মে ব্যাঘাত করার সম্ভাবনা থাকে, এমন যে কোনো কাজের প্রসঙ্গেই এটি সত্যি। তবে ডিজিটাল জ্ঞানসম্পন্ন বর্তমান প্রজন্মকে বড় করার ক্ষেত্রে, সীমা নির্ধারণের প্রাথমিক উপায় হিসাবে সময় মেপে দিলে তা সেরা উপায় নাও হতে পারে।
বাচ্চাদের প্রতিদিন কতক্ষণ মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করা উচিত, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, স্ক্রীন টাইম কতক্ষণ হওয়া উচিত অর্থাৎ মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস কতক্ষণ ব্যবহার করা উচিত, সেই সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য পরিচালিত গবেষণাটি উদ্দেশ্যহীনভাবে টিভি দেখার ভিত্তিতে ছিল (ইন্টারনেট চালু হওয়ার অনেক আগে)। টিভি দেখার বিষয়টি বর্তমানে বাচ্চাদের ব্যবহার করা বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল অ্যাক্টিভিটির থেকে অনেকটাই আলাদা। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার সীমাবদ্ধ করতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখবেন যে, সমস্ত ডিজিটাল কার্যকলাপের গুরুত্বই এক। বাস্তব সত্যির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না! আসুন উদাহরণ হিসাবে দুটি ডিজিটাল কার্যকলাপ দেখি; এর মধ্যে একটি হলো দাদু-দিদার/নানা-নানির সাথে ভিডিও চ্যাট করা এবং আরেকটি হলো ভাগ্য-ভিত্তিক কোনো অনলাইন গেম বারবার খেলা। দুটি কার্যকলাপের জন্যই ডিভাইস (স্ক্রীন রয়েছে এমন) ব্যবহার করা হয়, তবে প্রতিটি কার্যকলাপের গুরুত্ব অনেকটাই আলাদা। আমরা স্ক্রীন টাইম অনুসারে ডিভাইসের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করার সময় অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের শেখাই যে প্রযুক্তির ব্যবহার হলো বাইনারি (তা অনুমোদিত হোক বা অননুমোদিত) পদ্ধতি, যা শেখায় যে সমস্ত ডিজিটাল কার্যকলাপের গুরুত্ব সমান। কোন ডিজিটাল কার্যকলাপটি অন্য কার্যকলাপের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন কার্যকলাপের জন্য আমাদের বেশি সময় দেওয়া উচিত, তা চিনতে শেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা এই বাইনারি পদ্ধতিতে বা স্ক্রীন টাইমে পাওয়া যায় না।
পরিবারের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে টুল হিসাবে যদি স্ক্রীন টাইম ব্যবহার করার বিষয়টি পুরাতন মনে হয়, তাহলে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এর থেকে ভালো উপায় আর কী আছে? বাঁধা-ধরা স্ক্রীন টাইম ব্যবহার করার পরিবর্তে, আমাদের যে ধারণাটি শেখানো উচিত তা হলো ভারসাম্য বজায় রাখা। এটি হলো এমন একটি ধারণা যা আমরা প্রতিনিয়ত বাস্তব জগতে শেখাই। আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি যে, সুস্থ লোকেরা বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের লোকজনের সাথে এবং নিজের জন্য কাটানো সময়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখেন। তারা ব্যায়াম আর বিশ্রামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে জানেন। তারা সিরিয়াস হয়ে কাজ করার জন্য সময় বার করেন আবার হাসি মজা করার জন্যও খেলাধুলা করার সময় বার করেন।
বেশিরভাগ কার্যকলাপের গুরুত্ব অন্যান্য কার্যকলাপের সাথে তাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়। ব্যায়াম করা ভালো অভ্যাস, কিন্তু ব্যায়াম করার পিছনে আমাদের এতটা বেশি সময়ও ব্যয় করা উচিত নয় যে আমরা বাড়ির কাজ শেষ করতে না পারি বা পরিবারের লোকজন এবং বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে না পারি। বিশ্রাম নেওয়ার বিষয়টিও খুব জরুরি, কিন্তু বিশেষ করে অভ্যাসের কারণে বেশি সময় ধরে ঘুমানো আমাদের উৎপাদনশীলতা আর মানসিক স্বাস্থের ক্ষতি করে। কল্পনাপ্রবণ হওয়া ভালো, কিন্তু ভুল বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হলে তা মিথ্যা বলে বিবেচিত হয়।
ভারস্যম্য প্রতিদিন একই রকমের থাকবে সেটি নাও হতে পারে। যেমন, যে দিন কোনো বড় সায়েন্স প্রজেক্ট জমা দিতে হবে তার আগের দিন পুরো সময় বাইক চালিয়ে সময় কাটালে তা ক্ষতি করতে পারে। তাই, এইদিন নানা কাজের জন্য সময় দেওয়ার অনুপাত অন্য দিনের থেকে আলাদা হবে। বেহালা বাজানো সংক্রান্ত কোনো সংগীত অনুষ্ঠানের আগের দিন, বেহালা বাজানোর অনুশীলন করার পরিবর্তে সারা দিন পড়াশোনা করা অনুপযুক্ত হতে পারে, পরিবর্তে অন্য দিন পড়াশোনা করলে তা খুব ভালো হয়। মা-বাবা হিসাবে, বাস্তব জগতে আমাদের যখন মনে হয় যে কাজকর্মের মধ্যে ভারসাম্য নেই, তখন আমরা সেগুলোর কারণ বোঝার চেষ্টা করি। ভার্চুয়াল জগতেও ভারসাম্য খোঁজা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যেভাবে আমরা বাস্তব জীবনে আমাদের বাচ্চাদের যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করি, ঠিক সেভাবেই ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারে কীভাবে ভারসাম্য রাখতে হয়, সেই বিষয়ে আমাদের বাচ্চাদের শিখতে সাহায্য করার সময়ও সমানভাবে অবিচল থাকতে হবে। এক্ষেত্রে, নিচের তিনটি নীতি সাহায্য করতে পারে।
ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দিলে তা আমাদের বাচ্চাদের জন্য ভবিষ্যতের সাফল্য নির্ধারণ করে। আমরা চাই, সময় বেঁধে কোনো কিছু করার পরিবর্তে তারা যেন নিজেদের ইচ্ছাতেই শিখতে পারেন যে বিভিন্ন কাজের মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে রাখতে হয়।